ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫ , ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিবিসির প্রতিবেদন

যেভাবে রুশ ঘাঁটিতে ‘স্পাইডার ওয়েব’ হামলা চালাল ইউক্রেন

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ০৩-০৬-২০২৫ ০৩:৪৫:০৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৩-০৬-২০২৫ ০৩:৪৫:০৯ অপরাহ্ন
যেভাবে রুশ ঘাঁটিতে ‘স্পাইডার ওয়েব’ হামলা চালাল ইউক্রেন ​বাঁয়ের অংশে বিশেষভাবে সজ্জিত কেবিন। মাঝের অংশে কেবিনে লুকানো ড্রোন। ডানে ট্রাক থেকে উৎক্ষেপণ করা ড্রোন | ছবি- এসবিইউ (টেলিগ্রাম))
১৮ মাস ধরে পরিকল্পিত এক সাহসী ও জটিল অভিযানে রোববার (১ জুন) রাশিয়ার গভীরে অন্তত পাঁচটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে একযোগে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। ‘স্পাইডার ওয়েব’ নামে পরিচিত এই অপারেশনে ১১৭টি ড্রোন ব্যবহার করে ইউক্রেন একযোগে রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলার বিস্তৃতি ছিল আর্কটিক সার্কেলের ওপরে মুরমানস্ক থেকে শুরু করে ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে ৮,০০০ কিলোমিটার দূরের আমুর অঞ্চল পর্যন্ত।

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে যে, মুরমানস্ক, ইরকুতস্ক, ইভানোভো, রিয়াজান ও আমুর—এই পাঁচটি অঞ্চলে হামলা হয়েছে। তবে তারা দাবি করে, শুধুমাত্র মুরমানস্ক ও ইরকুতস্কে বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাকি হামলাগুলো আটকানো গেছে।

ইউক্রেনের সিকিউরিটি সার্ভিসের (এসবিইউ) প্রধান ভাসিল মালিউক পরে জানান, এই ড্রোনগুলোকে কাঠের কেবিনের মধ্যে লুকিয়ে ট্রাকের মাধ্যমে রাশিয়ায় পাচার করা হয়েছিল। কেবিনগুলোর ছাদ ছিল রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে খোলা যায় এমন। ট্রাকচালকরা নিজেদের অজ্ঞাতে এসব ঘাঁটির কাছে গিয়ে পার্ক করলে ড্রোনগুলো সেই স্থান থেকেই উৎক্ষেপণ করা হয়।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম রিয়া নোভোস্তি এক চালকের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বুঝতে পারলাম ট্রাকের পেছন থেকে ড্রোন বের হচ্ছে তখন আমরা পাথর ছুড়ে তা আটকে রাখার চেষ্টা করি।‘

নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল বাজা জানায়, এই চালকদের অধিকাংশই ভেবেছিলেন তারা সাধারণ কাঠের ঘর বহন করছেন। পরবর্তীতে ফোনে নির্দেশ পেয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ট্রাক পার্ক করলে তারা ড্রোন উৎক্ষেপণের সাক্ষী হন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই অভিযান প্রত্যক্ষভাবে তত্ত্বাবধান করেছেন বলে জানানো হয়। এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে জেলেনস্কি বলেন, ‘এই অভিযান প্রস্তুত করতে এক বছর ছয় মাস নয় দিন সময় লেগেছে।‘ তিনি আরো জানান, হামলার একটি লক্ষ্য ছিল রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির একটি কার্যালয়ের পাশেই।

রাশিয়া হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে কিছু মানুষকে আটক করার কথা বললেও জেলেনস্কি জানান, যারা এই অভিযান বাস্তবায়নে সহায়তা করেছেন, তাদের সবাইকে রাশিয়ার বাইরে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক ড্রোন বিশেষজ্ঞ ড. স্টিভ রাইট বলেন, এই হামলায় ব্যবহৃত ড্রোনগুলো ছিল সাধারণ কোয়াডকপ্টার, যা তুলনামূলকভাবে ভারী বিস্ফোরক বহনে সক্ষম। তবে এই অভিযানের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক ছিল—এগুলোকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে পৌঁছে দেয়া এবং সেগুলোকে রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা। সম্ভবত স্যাটেলাইট বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এমনকি রাশিয়ার জ্যামিং প্রযুক্তিও ড্রোনগুলো ঠেকাতে পারেনি, কারণ কিছু ড্রোন ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রিত ছিল বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

এই ড্রোনগুলো কোথায় তৈরি তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই স্থানীয়ভাবে ড্রোন উৎপাদনে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে।

জেলেনস্কি বলেন, ‘রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি বাস্তব ও ন্যায্য।‘ ইউক্রেনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৪১টি কৌশলগত বোমারু বিমান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ১৩টি ধ্বংস হয়েছে।

বিবিসি যাচাই করে দেখেছে, মুরমানস্কের ওলেনেগোরস্ক ও ইরকুতস্কের বেলায়া বিমানঘাঁটিতে বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলায় যেসব বিমানকে টার্গেট করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম টিইউ-৯৫, টিইউ-২২ এবং টিইউ-১৬০। যুদ্ধবিমানগুলো আর উৎপাদন হয় না। তাই এসবের প্রতিস্থাপন প্রায় অসম্ভব। রাডার স্যাটেলাইট ছবি অনুসারে, শুধুমাত্র বেলায়া বিমানঘাঁটিতেই অন্তত চারটি বোমারু বিমান ধ্বংস বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এসব টু-৯৫ বিমান থেকে সম্প্রতি ইউক্রেনের ওপর বড় পরিসরে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। প্রতিটি বোমারু বিমান ৮টি ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম, যার প্রতিটির ওজন প্রায় ৪০০ কেজি।

উল্লেখযোগ্যভাবে, রাশিয়ার এ-৫০ সামরিক নজরদারি বিমানও এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল। এগুলো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে এবং পাল্টা হামলা চালাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা প্রধান কিরিলো বুদানভ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, রাশিয়ার এমন মাত্র আটটি বিমান রয়েছে—ফলে যেকোনো ক্ষয়ক্ষতি মস্কোর জন্য মারাত্মক।

ইউক্রেনের সিকিউরিটি সার্ভিস দাবি করে, এই অভিযানে রাশিয়ার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। রুশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এই হামলা নিয়ে একেবারেই নীরব থেকেছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনে এই অভিযান নিয়ে ব্যাপক উদযাপন হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একে কেউ কেউ ‘টাইটানিক সফলতা’ বলে অভিহিত করেছেন।

জেলেনস্কি বলেন, ‘সবকিছু এখন প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে এই ইউক্রেনীয় অভিযান ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।‘

বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ